আগামীর স্বপ্ন

সপ্তম শ্রেণি (দাখিল) - জীবন ও জীবিকা - NCTB BOOK

একটু অতীতে ফিরে যাই। ৩০ থেকে ৪০ বছর আগের কোনো এক মিষ্টি বিকেলে, নরম ঘাসের উপরে আলতো পায়ে হাঁটছে কেউ একজন ! সে হাত নেড়ে হেসে কথা বলছে অদৃশ্য কারও সঙ্গে! সেই সময়কার মানুষ এই দৃশ্য দেখলে তাকে বলত ‘আস্ত একটা পাগল!' একটু ভেবে বলত, আজকের দিনে এই দৃশ্য দেখলে আমরা কি তা করব? এই দৃশ্য তো এখন আমরা হরহামেশাই দেখি ! ইয়ারবাড কানে দিয়ে হাঁটছে আর কথা বলছে অন্য প্রান্তের কারও সঙ্গে। হতে পারে ওপ্রান্তে যিনি আছেন তিনি হয়তো সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে ! কানে রাখা ছোট্ট এই ইয়ারবাড ব্লুটুথের মাধ্যমে যুক্ত থাকে তার ফোনে। মজার বিষয় হলো- ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ নামের একটি উপন্যাসে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর এমন এক সময়ের গল্প ছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, মানুষ কানে ঝিনুকের মত যন্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, যার মাধ্যমে তৈরি হয় শব্দের বৈদ্যুতিক মহাসাগর, পৃথিবীর সব শব্দ শোনা যায় এই কল্লোলে। কল্পনার সেই আগামী যে আজকের বর্তমান !

ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমরা এ রকম বেশকিছু ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি সম্পর্কে জেনেছি। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রযুক্তি ছিল কল্পনা, যেমন টাইম মেশিন। আমরা জানি না, ভবিষ্যতে টাইম মেশিন উদ্ভাবিত হবে কি হবে না! আবার কিছু প্রযুক্তি এমন ছিল যা বর্তমানেই বিদ্যমান ভবিষ্যতে এর ব্যবহার উত্তরোত্তর আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে, যেমন থ্রিডি প্রিন্টিং। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে যুগে যুগে বিভিন্ন সময়ে প্রযুক্তি বদলের সঙ্গে বিভিন্ন পেশাতেও পরিবর্তন এসেছে। যেমন একসময় বাংলাদেশে উনবিংশ শতাব্দীতে ভিস্তিওয়ালা পেশা প্রচলিত ছিল। সে সময়ে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে সুপেয় পানি সরবরাহের লাইন ছিল না। ভিস্তিওয়ালারা পশুর চামড়ায় তৈরি ‘মশক’ নামের থলেতে করে পানি বহন করতেন ও ফেরি করে সেই পানি বিক্রি করতেন সাধারণ মানুষের কাছে।

বর্তমান যুগে ভিস্তিওয়ালা নামের ওই বিশেষ পেশা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে রাস্তায় ফেরি করে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করার জন্য ফেরিওয়ালা পেশা এখনও রয়ে গেছে। কে জানে ভবিষ্যতে ফেরিওয়ালা পেশাটিও থাকবে কি না! হয়তো মানব ফেরিওয়ালার জায়গা দখল করে নেবে রোবট ফেরিওয়ালা!

আবার কয়েক যুগ আগেও খুব প্রচলিত একটি পেশা ছিল ঘোড়ার গাড়ি চালানো তথা কোচোয়ান। কোচোয়ানের কাজ ছিল ঘোড়ার গাড়িতে করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মানুষ ও বিভিন্ন পণ্য পরিবহন করা। এখন কিন্তু খুব কম জায়গায়ই কোচোয়ান ও ঘোড়ার গাড়ি দেখা যায়। তার পরিবর্তে গাড়ি, রিকশা ইত্যাদির চালক আমরা দেখতে পাই। কোনো একসময় হয়তো গাড়ির চালক হিসেবে মানুষকেও আর দেখা যাবে না, গাড়ি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলবে। তার মানে গাড়ির চালকের পেশাও একসময় বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

এমন অনেক পেশাই ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হতে পারে অর্থাৎ ঐ পেশার কাজগুলো আর মানুষ করবে না। তবে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এমন অনেক নতুন পেশা উপস্থিত হয়েছে, যা কয়েক দশক আগেও কল্পনা করা যেত না! আমরা এমন বেশকিছু প্রযুক্তি ও পেশা সম্পর্কে এই অধ্যায়ে জানব । এ ক্ষেত্রে আমরা এমন সব প্রযুক্তি ও পেশা বেছে নিয়েছি, যেগুলো ইতিমধ্যে উপস্থিত হয়েছে ও অদূর ভবিষ্যতে বিশাল চাহিদা হবে।

তার আগে আমরা এ রকম প্রযুক্তি ও পেশাগুলো অনুমান করার চেষ্টা করি। নিচে বেশকিছু রূপক ছবি দেওয়া আছে, যেগুলোতে এ রকম প্রযুক্তি ও পেশা সম্পর্কে সংকেত দেওয়া আছে। দেখি তো আমরা নিজেদের কল্পনা থেকে এগুলো সম্পর্কে ধারণা করতে পারি কি না !

যদি আমরা কোনোটি সম্পর্কে ধারণা করতে না পারি, তাতেও মন খারাপের কিছু নেই। যেটা আমাদের অনুমান হয়, সেটাই আমরা লিখি।

সবকটি ছবি দেখে তুমি হয়তো বুঝতে পারছ না কোনোটির কী কাজ। তাই না? এখানে আমরা আসলে খুবই সাম্প্রতিক কিছু পেশার চিত্র তুলে ধরেছি, যেগুলোর সঙ্গে তোমার হয়তো আগে থেকে একদম পরিচয় নেই। তাই তোমাদের বুঝতে সমস্যা হতে পারে কোন ছবির মানুষ কোন পেশায় নিযুক্ত। চিন্তার কিছু নেই, এই পেশাগুলো সম্পর্কে আমরা এখনই পরিচিত হতে যাচ্ছি। চল আমরা নিচের গল্পটি পড়ি।

 

২০৪১ সালের একদিন

‘সুপ্রভাত! ঘুম থেকে উঠে পড়ুন, নতুন দিন হাতছানি দিচ্ছে!”

রোবট হেনা ৪.০ এর মধুর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল প্রপার। প্রপা একজন বিগ ডাটা ইঞ্জিনিয়ার। আজ ২৬ মার্চ ২০৪১। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের ৭১তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে বিশেষ এক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। সেখানে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা হবে, প্রপা তাদেরই একজন। আজকের দিনটি তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের হবার পাশাপাশি প্রপার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। প্রপা বিছানায় পাশ ফিরে দেখল, ওর সাত বছর বয়সী মেয়ে শ্রুতিও জেগে উঠেছে।

‘শুভ সকাল মা। শুভ স্বাধীনতা দিবস'! 

শ্রুতির কথা শুনে খুশিতে ওকে জড়িয়ে ধরলেন প্রপা। 

‘মামণি তুমি উঠে গেছ। আজকে তো আমাদের দেশের খুবই আনন্দের একটি দিন। ‘যাও মামণি দাঁত মেজে আসো।' 

এই বলে প্রপা নিজেও বিছানা থেকে উঠলেন। 

একটু পর খাবার টেবিলে সকালের নাশতার জন্য অপেক্ষা করছে প্রপা ও শ্রুতি। 

এমন সময়ে সকালের নাশতা নিয়ে টেবিলে হাজির হলো রোবট হেনা ৪.০ । 

শ্রুতি খুবই কৌতূহলী শিশু। সব বিষয়েই ওর নানা প্রশ্ন ও কৌতূহল থাকে।

হঠাৎ শ্রুতি মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা মা, হেনা তো একটা রোবট। ও কীভাবে আমাদের জন্য সকালের নাশতা তৈরি করে? কোনো কাজই তো না শিখে করা যায় না। হেনা কীভাবে নাশতা বানানো শিখল?'

এই প্রশ্ন শুনে প্রপা বলল, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নামে একটি বিশেষ প্রযুক্তি আছে। একজন মানুষ যেভাবে বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করে একটা কাজ শিখে করতে পারে, ঠিক তেমনি যন্ত্রকে নতুন একটা কাজ কীভাবে করতে হয় সেটা শিখিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিশেষজ্ঞ হেনার মতো রোবটদের শিখিয়েছেন কীভাবে রান্না করতে হয়। তাই হেনা আমাদের জন্য রান্না করতে পারে ও সেটা আবার খাবার টেবিলে নিয়ে আসতে পারে। পুরো জিনিসটাই হেনাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে।’

সকালের নাশতা শেষ করার পর, হঠাৎ প্রপা লক্ষ করল তার মোবাইল ফোনে একটি মেসেজ এসেছে ‘ফ্রিজে ডিম শেষ হয়ে গিয়েছে, অনুগ্রহ করে নিকটস্থ দোকান থেকে ডিম অর্ডার করে নিন।'

শ্রুতি মাকে জিজ্ঞেস করল ‘কী হয়েছে মা? মোবাইল ফোনে কি বাবা কোনো মেসেজ পাঠিয়েছে?”

শ্রুতির বাবা রায়হান বর্তমানে ব্যবসায়িক কাজে আমেরিকায় অবস্থান করছেন। তাই শ্রুতি প্রায়ই তার বাবাকে মিস করে।

প্রপা বলল, ‘না ‘মামণি। তোমার বাবা মেসেজ করেন নি। আমাদের ফ্রিজ থেকে নোটিফিকেশন এসেছে ডিম শেষ হয়ে গেছে।'

এবারে শ্রুতি অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ মা আগেও দেখেছি ফ্রিজ এ রকম নোটিফিকেশন দেয়, কোনো খাবার শেষ হয়ে গেলে। কিন্তু ফ্রিজ এটা কীভাবে করে মা? ফ্রিজও তো একটা যন্ত্র!”

প্রপা হেসে বললেন, ‘শুধু ফ্রিজ না, আমাদের সকল ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র ইন্টারনেটের মাধ্যমে একটি নেটওয়ার্কে যুক্ত। এই বিশেষ নেটওয়ার্কে একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যার নাম ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটি। আইওটি প্রযুক্তিতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত যেকোনো যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় পৃথিবীর যেকোনো প্ৰান্ত থেকে। ফ্রিজে রাখা প্রতিটি খাবারের সংখ্যা হিসাব রাখে ফ্রিজে থাকা বিশেষ সেন্সর। যখন কোনো খাবার শেষ হয়ে যায়, তখন সেই সেন্সর থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমার মোবাইল ফোনে বিশেষ বার্তা চলে আসে- এই খাবারটি শেষ হয়ে গেছে। শুধু ফ্রিজ না, বাসায় থাকা টেলিভিশন, বাতি, পাখা সবকিছুই তো আইওটির কারণে আমি মোবাইল থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এমনকি তোমার বাবা আমেরিকায় বসেও চাইলে আমাদের বাসার এই যন্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এই চমৎকার কাজটি করেন আইওটি ইঞ্জিনিয়াররা।'

শ্রুতি বেশ অবাক হয়ে মায়ের কথা শুনছিল। শ্রুতির মাথায় আরও প্রশ্ন জড়ো হয়েছে। তাই শ্রুতি মাকে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা মা, সবকিছু যে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। ইন্টারনেট কাজ না করলে তো যন্ত্রগুলো চালানো যাবে না। এটা কি ঝুঁকিপূর্ণ না?”

প্রপা মেয়ের প্রশ্ন শুনে বলল, ‘হ্যাঁ, ইন্টারনেট যদি সচল না থাকে তাহলে যন্ত্রগুলোকে ম্যানুয়ালি তো নিয়ন্ত্ৰণ করাই যায়, আগে যেভাবে মানুষ করত। তবে অন্য একটা ঝুঁকিও আছে। ইন্টারনেটের জগতে এমন কিছু অপরাধী আছে যারা অনলাইন নেটওয়ার্ক বা কম্পিউটার থেকে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করার চেষ্টা করে। আবার বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে থাকা মানুষের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে সেখানে লগইন করে অবৈধ কাজ করার চেষ্টা করে। এমনকি এভাবে করে আইওটি প্রযুক্তিতে যুক্ত বিভিন্ন যন্ত্রকেও হ্যাক করে অবৈধ কাজে ব্যবহারের চেষ্টা করে এসব অপরাধীরা।’

এ কথা শুনে শ্রুতি একটু চিন্তিত হয়ে বলল, ‘ওরা তো তাহলে ভালো না মা! অনলাইনে বা ইন্টারনেটে তাহলে তুমি কীভাবে নিরাপদ থাকো?”

শ্রুতিকে আশ্বস্ত করে প্রপা বলল, ‘যারা অনলাইনে এ রকম অপরাধ করার চেষ্টা করে তাদের প্রতিহত করার জন্য ও অনলাইন বিভিন্ন সেবা ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তার জন্য সাইবার সিকিউরিটি প্রযুক্তি আছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের দেশের সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞরা অনলাইন বিভিন্ন প্লাটফর্মের নিরাপত্তা রক্ষা করেন। 

এমনকি আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতেও সাইবার সিকিউরিটি বিভাগ আছে। যেকোনো অনলাইন অপরাধ হলে তারাই সেটি শনাক্ত করে সাইবার অপরাধীদের ধরে ফেলেন। ফলে আমাদের এই নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না।'

এ কথা শুনে শ্রুতি আবার একটু স্বস্তি পেল। এ সময়ে প্রপা অনলাইন সামাজিক মাধ্যমে কিছু নোটিফিকেশন দেখছিলেন। হঠাৎ সে লক্ষ্য করলেন, তাকে এই সামাজিক মাধ্যমে একটি বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে, ‘টাটকা মুরগির ডিম কিনতে এখনই ভিজিট করুন ……ডট কম।'

প্রপা শ্রুতিকে ডেকে বিজ্ঞাপনটা দেখালেন। শ্রুতি বেশ অবাক হয়ে বলল, ‘আমাদের তো মুরগির ডিম অবশ্যই কিনতে হবে। কিন্তু এই বিজ্ঞাপনটাই কেন দেখাল! এরা কি কোনো জাদু দিয়ে জেনে নিয়েছে আমরা মুরগির ডিমই খুঁজছি!

মেয়ের কথা শুনে প্রপা মুচকি হেসে বলল, ‘ওরা জাদু জানে না। কিন্তু ওরা একটা বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে, যেটার নাম হলো ডিজিটাল মার্কেটিং। এই সামাজিক মাধ্যম জানে আমি কী কী বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে অনুসন্ধান করেছি। ডিম নিয়েও তো আগে অনুসন্ধান করেছি যেকোনো দোকান থেকে অর্ডার করা যেতে পারে। যেহেতু মাধ্যমটি বুঝতে পেরেছে আমি মুরগির ডিম খুঁজছি, তাই এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আমার কাছে ডিমের মার্কেটিং করেছে বা বিজ্ঞাপন দিয়েছে। একইভাবে সকল ব্যবহারকারীর কাজকর্ম, আগ্রহ, পছন্দ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে সেই অনুযায়ী এই প্ল্যাটফর্মে ঐ ব্যবহারকারীর সঙ্গে সম্পর্কিত বিজ্ঞাপনই দেখানো হয়। বর্তমানে যারা ডিজিটাল মার্কেটিং এর সাথে সম্পৃক্ত তাদের কাজই হলো কত সহজে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে টার্গেট গ্রাহকের কাছে নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপন পৌঁছে দেওয়া যায়।’

আপাতত শ্রুতির মাথায় আর কোনো প্রশ্ন নেই। প্রপা ও শ্রুতি দুজনেই তৈরি হয়ে নিল স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যাবার জন্য। এবার গাড়িতে করে অনুষ্ঠানে যাবার পালা।

প্রপা নিজে গাড়ি চালাতে পছন্দ করে, তাই গাড়ির অটোমেটিক মুড বন্ধ করে গাড়ি চালানো শুরু করল। প্রপার চোখে একটি বিশেষ চশমা লাগানো আছে। ওই চশমায় রাস্তায় চলার নির্দেশনা, কত বেগে গাড়ি যাচ্ছে ইত্যাদি তথ্য ভেসে উঠছে। সেটি অনুসরণ করে গাড়ি চালাচ্ছে প্রপা। পাশাপাশি রাস্তার কোথায় কোন ভবন আছে সেগুলোও স্পিকারে জানিয়ে দিচ্ছে ওই বিশেষ চশমা। শ্রুতি গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল।

এমন সময়ে প্রপা বলল, ‘আরও একটা প্রযুক্তির সঙ্গে তোমাকে পরিচিত করে দিই। আমার কাছে যেই চশমা আছে, সেই চশমায় কোন রাস্তার পর কোন রাস্তায় যাব এই নির্দেশনা চলে আসছে। এটা হচ্ছে অগমেন্টেড রিয়েলিটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এই প্রযুক্তিকে বাস্তব জগতের এক বর্ধিত সংস্করণ বলা যায়। আমরা বাস্তবে যা দেখতে পাই তার উপর কম্পিউটার নির্মিত আরও একটি অতিরিক্ত ধাপ যুক্ত হয়। ফলে বাস্তবের তুলনায় একটু ভিন্ন নতুন অনুভূতি পাই আমি। বাস্তব জগতে যা কিছু ঘটছে সেটা তো অনুভব করছিই, পাশাপাশি কম্পিউটার দিয়ে তৈরি অতিরিক্ত ধাপটি আমাকে শব্দ, ভিডিও, গ্রাফিক্স ইত্যাদির মাধ্যমে আরও নতুন তথ্য ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করছে। আবার পুরো জিনিসটাই ভয়েস কমান্ডের মাধ্যমে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি। আমার ব্যবহার করা স্মার্ট চশমার পাশাপাশি মোবাইল ফোন দিয়েও অগমেন্টেড রিয়েলিটির জগতের অভিজ্ঞতা নেওয়া যায়।’

শ্রুতি খুব মনোযোগ দিয়ে মায়ের কথা শুনছিল। সে বলল, ‘মা তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আজ কতগুলো নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারলাম!'

এরই মধ্যে মূল অনুষ্ঠানের স্থানে উপস্থিত হয়েছে প্রপারা। অনুষ্ঠান চলমান। এক পর্যায়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘৭১তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছি আমরা আজ। আজকের দিন আমাদের জন্য খুব আনন্দের। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যারা বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন, আজ আমরা তাদের সম্মান জানাতে চাই। প্রথমেই আমি বলতে চাই, বিশিষ্ট বিগ ডাটা ইঞ্জিনিয়ার প্রপার কথা।’

‘আপনারা নিশ্চয়ই জানেন পূর্বে বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা ছিল, প্রতিবছর বন্যায় নদীভাঙ্গন হতো ও অনেক মানুষ গৃহহীন হতো। আমাদের কাছে প্রতিবছর কোন এলাকায় কোন দিন কতটুকু বৃষ্টিপাত হয়েছে ও কোন এলাকায় কতটুকু পানি উঠেছে এই তথ্য ছিল। এই তথ্যের পরিধি ছিল বিশাল এবং অগোছালো। এমন সময়ে এগিয়ে আসেন একদল বিগ ডাটা ইঞ্জিনিয়ার। বিগ ডাটা প্রযুক্তিতে বিশাল পরিধির অগোছালো তথ্যকে নির্দিষ্ট এলগরিদম অনুসরণ করে সাজানো যায় ও সেই তথ্যকে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট কোনো সমস্যার সমাধান করা যায়। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা প্রতিবছরের বৃষ্টিপাতের ও পানি উঠার পরিমাণের তথ্য থেকে এমন একটি মডেল দাঁড় করিয়েছেন, যেখান থেকে এখন আমরা অগ্রিম বুঝতে পারছি এই বছর কোন এলাকায় কতটুকু বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা আছে ও কোন এলাকায় কতটুকু পানি উঠতে পারে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন এলাকায় থাকা বাঁধগুলো কীভাবে কতটুকু সচল রাখলে বিভিন্ন নদীর নাব্যতা স্বাভাবিক রেখে বন্যা পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, সেটিও এই মডেল থেকে বের করা যাচ্ছে। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা কমেছে। এই যুগান্তকারী কাজটির জন্য বিগ ডাটা ইঞ্জিনিয়ারদের দলপ্রধান প্রপাকে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করছি।'

করতালি দিয়ে সবাই প্রপাকে অভিনন্দন জানালেন।

এমন সময়ে হঠাৎ শ্রুতির ঘুম ভেঙ্গে গেল। লাফ দিয়ে উঠে বসল শ্রুতি।

২০২৩ সালের ১লা জানুয়ারি আজ।

হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে শ্রুতির বেশ অবাক লাগল।

এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিল শ্রুতি! ওহ আজ তো বছরের প্রথম দিন। সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছে শ্রুতি। বিদ্যালয়ে গিয়ে কত নতুন বই হাতে পাবে! কিন্তু কী সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছে শ্রুতি।

সত্যি কি ২০৪১ সালে এমন কিছু হবে? জানে না শ্রুতি। দ্রুত উঠে বিদ্যালয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হওয়া শুরু করল শ্রুতি।

 

ভবিষ্যতের প্রযুক্তির সন্ধান

দলগত কাজ

গল্পে এমন বেশ কয়েকটি প্রযুক্তির কথা আমরা জেনেছি যে প্রযুক্তিগুলো অদূর ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এমন প্রযুক্তিগুলোর নাম নিচের ছকে লিখি। পাশাপাশি গল্প থেকে প্রযুক্তিটি সম্পর্কে যেটুকু ধারণা পেয়েছি, তার আলোকে মানবকল্যাণে কোন কোন ক্ষেত্রে সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে তা কল্পনা করি এবং দলে আলোচনা করে এখানে সাজিয়ে লিখি।

একক কাজ

এবারে কল্পনা করো তুমি নিজে ভবিষ্যতে পেশা হিসেবে এ রকম একটি প্রযুক্তি ক্ষেত্রকে বেছে নিয়েছ। তোমার নিজের পেশাকে কল্পনা করে নিজের একটি ছবি আঁকো এবং তুমি দেশের কল্যাণে সেই পেশায় কী কী অবদান রাখতে চাও সেটি নিজের কল্পনা অনুযায়ী লেখো।

আমার পেশার নাম :
আমার পছন্দ করা প্রযুক্তি ক্ষেত্র:

এই কাল্পনিক পেশায় আমার পালন করা বিভিন্ন দায়িত্ব:

 

 

 

এই কাল্পনিক পেশায় দায়িত্বরত অবস্থায় আমার ছবি: (অঙ্কন অথবা বর্ণনা করো)

 

 

 

দলগত কাজ

প্রতিটি দল নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একটি করে নাটকের স্ক্রিপ্ট তৈরি করো। ২০৪১ সালে এ রকম বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তির কারণে আমাদের সমাজে কীরকম পরিবর্তন আসবে তা নিয়ে সর্বোচ্চ ৫ মিনিটের নাটক তৈরি করো। নাটকে দলের সদস্যরা একেক জন একেক পেশায় অভিনয় করবে। আমাদের অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটে উঠবে উপরে উল্লিখিত বিভিন্ন পেশার মানুষেরা সমাজের কল্যাণে কী কী ভূমিকা রাখছেন। প্রতিটি দলের নাটক আমরা উপভোগ করব ও সম্ভব হলে সেগুলো ক্যামেরায় ভিডিও আকারে ধারণ করে রাখব।

আজ থেকে শতবছর আগের দুনিয়ার সঙ্গে আজকের কত তফাৎ! তাই না? প্রযুক্তি বদলে দিয়েছে কত কিছু! আবার প্রযুক্তিকে মাঝে মাঝে খোরাক দিয়েছে আমাদের কল্পবিলাসী মন। এক সময়ের কল্পনার কত কিছুই তাই আজ বাস্তব হয়ে ধরা দিচ্ছে আমাদের সামনে। কাল্পনিক এ রকম আরেকটা সিনেমার গল্প আমরা খুঁজে পাই ১৯৬৮ সালের ‘২০০১: অ্যা স্পেস ওডিসি'তে। যেখানে দেখা যায়- মহাকাশযানে থাকা একটি বিশেষ কম্পিউটারের মাধ্যমে মহাকাশে বসেই এক লোক পৃথিবীতে তার মেয়েকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। আজ তো সেই কল্পনা একেবারেই বাস্তব হয়ে উঠেছে আমাদের ঘরে ঘরে। এক টিপেই মুঠোয় থাকা ফোনের পর্দায় ভেসে উঠছে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে থাকা প্রিয়জনের হাসিমুখ! আর এই পর্দার পিছনে কাজ করছেন কতশত বিজ্ঞানী, গবেষক, প্রোগামার, সার্ভিস প্রোভাইডারসহ আরও কত পেশাজীবী মেধাবী শ্রমিক ! আমরাও তাই আগামীর স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নকে বাস্তব করার স্বপ্ন বুনি এবং নিজেকে সেভাবে গড়ে তুলি।

 

১। আগামী দিনে তুমি কোন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে চাও? উক্ত প্রযুক্তি সম্পর্কে তুমি কী কী জানো? উক্ত প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার উপযোগী করে নিজেকে গড়ে তুলতে অন্যান্য আর কী কী যোগ্যতার অনুশীলন এখন থেকেই করা প্রয়োজন?

যে প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে চাইউক্ত প্রযুক্তি সম্পর্কে যা জানিউক্ত প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে চাইলে কী কী যোগ্যতার অনুশীলন এখন থেকেই করা প্রয়োজন

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

  

 

২. এই অধ্যায়ে আমরা যা যা করেছি ........ (√ টিক চিহ্ন দাও)

কাজসমূহকরতে পারিনি (১)আংশিক করেছি (৩)ভালোভাবে করেছি (৫)
নতুন প্রযুক্তি ও পেশার নাম অনুসন্ধান করা   
২০৪১ সালের একদিন গল্পটি পড়া   
মানবকল্যাণে আগামীর প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে কল্পনা করা   
দেশের কল্যাণে আগামীদিনের পেশায় অবদান রাখার গল্প তৈরি   
আধুনিক প্রযুক্তির কারণে আমাদের সমাজে কী রকম পরিবর্তন আসবে তা নিয়ে নাটক তৈরি   
নাটকে অংশগ্রহণ   
মোট স্কোর: ৩০আমার প্রাপ্ত স্কোর :
আমার অভিভাবকের মন্তব্য:
শিক্ষকের মন্তব্য:

এই অধ্যায়ের যেসব বিষয় আমাকে আরও ভালোভাবে জানতে হবে তা লিখি-

 

 

 

যে কাজগুলোর নিয়মিত চর্চা আমাকে চালিয়ে যেতে হবে সেগুলো লিখি-

 

 

 

 

Content added By

আরও দেখুন...

Promotion

Promotion